পার পেয়ে যাচ্ছে তনুর খুনিরা!

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুর দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেও মৃত্যুর কারণ অধরা রয়ে গেছে। আদালতের নির্দেশে গঠিত ৩ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড সুস্পষ্ট করে তনুর মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করতে পারেনি। মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যরা ঘটনার পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে পুলিশকে অধিকতর তদন্তের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া মৃত্যুর আগে ধর্ষণ নয় তার সঙ্গে ‘সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স’ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

রবিবার দুপুরে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যরা এসব তথ্য জানান। এর আগে বেলা ১১টার দিকে সিআইডি-কুমিল্লার কার্যালয়ে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়।

এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ময়নাতদন্তের এই প্রতিবেদনের কারণে তনুর পরিবারের ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হল। কারণ পুলিশের চার্জশিটের বড় শক্তি হল এই প্রতিবেদন। এখানে খুনিদের বিরুদ্ধে শক্ত কোন তথ্যই দাঁড় করানো যায়নি। ফলে এই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের কারণে শেষ পর্যন্ত বিচারে গিয়ে অপরাধীরাই সুবিধা পাবে।
Read More News

এদিকে প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের মতো দ্বিতীয় প্রতিবেদনটিও মিথ্যা ও বানোয়াট বলে প্রত্যাখ্যান করেছে তনুর পরিবার। তারা প্রশ্ন তুলেছেন- দুই দফা ময়নাতদন্তেও মৃত্যুর কারণ খুঁজে পায়নি ডাক্তাররা, তাহলে তনু মরল কীভাবে? এছাড়া সিআইডি’র ডিএনএ রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত পাওয়ার পর এখন ডাক্তাররা বলছেন ‘সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সে’র কথা- যা দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন তনুর বাবা-মা। তারা বলেন, একটি অবিবাহিত মেয়েকে হত্যার পর তার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করলেন চিকিত্সকরা। এটা তারা করতে পারেন না। আন্তর্জাতিক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক ও ইন্দো প্যাসিফিক এসোসিয়েশন অব ল’ মেডিসিন এন্ড সায়েন্সের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক ইত্তেফাককে বলেন, ‘প্রথম ময়নাতদন্তের সময় তার মৃত্যুর কারণ যেহেতু চিকিত্সক নির্ণয় করতে পারেননি, সেহেতু লাশটি সংরক্ষণ করা উচিত্ ছিল। তখনই দ্বিতীয় দফায় বোর্ড গঠন করে ময়নাতদন্ত করা দরকার ছিল। তখন লাশটি দাফন করা ঠিক হয়নি। আন্তর্জাতিক ফরেনসিক আইন অনুযায়িও মৃত্যুর কারণ না পাওয়া পর্যন্ত লাশ দাফন করা যায় না। তারপর তার ডিএনএ নিয়েও প্রশ্ন আছে। তাছাড়া তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ এখনো হত্যার ঘটনাস্থল সনাক্ত করতে পারেনি। অথচ ঘটনাস্থল সনাক্ত হওয়ার পর সেখান থেকেই অনেক আলামত সংগ্রহ করতে হয়।’

জানা গেছে, ডিএনএ প্রতিবেদন পাওয়া নিয়ে নানা অজুহাতে চিঠি চালাচালি শেষে তনু হত্যাকান্ডের ৮৪ দিন পর এবং কবর থেকে মরদেহ উত্তোলনের ৭৪ দিনের মাথায় গতকাল দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সিআইডি’র নিকট হস্তান্তর করে ৩ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড। বেলা ১১টার দিকে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের অফিস সহায়ক মো. ফারুক ও ডোম মাহে আলম এ প্রতিবেদনটি সিআইডি-কুমিল্লা কার্যালয়ে হস্তান্তর করেন। প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেন সিআইডি-কুমিল্লার এএসআই মোশাররফ হোসেন।

পরে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ ও ময়নাতদন্তকারী বোর্ডের প্রধান ডা. কামদা প্রসাদ সাহা তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, তনুর ডিএনএ প্রতিবেদন, অন্যান্য পরীক্ষার পারিপার্শ্বিক দিক পর্যালোচনাসহ দ্বিতীয় ময়নাতদন্তে দেখা গেছে, মৃত্যুর আগে তার ‘সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স’ হয়েছে। দ্বিতীয়ত যেহেতু ১০ দিন পরে মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ওঠানো হয়েছে, ফলে মৃতদেহটি পচা ছিল। পচা-গলা মৃতদেহ থেকে নতুন করে ইনজুরি বোঝা সম্ভব হয়নি। তাই পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে পুনরায় ইনভেস্টিগেশন হলে মৃত্যুর কারণ পাওয়া যেতে পারে। মৃত্যুর আগে তনু ধর্ষিত হয়েছিল কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ধর্ষণ হচ্ছে একটা লিগ্যাল টার্ম, এটা সায়েন্টিফিক টার্ম না। পেনিস (লিঙ্গ) লাগলেই ধর্ষণ হয়।’ এই কথার অর্থ তনুকে হত্যার আগে ধর্ষণ করা হয়েছে কি-না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে ডা. প্রসাদ বলেন, ‘আপনারাই বুঝে নেন।’

এসময় মেডিক্যাল বোর্ডের অপর সদস্য ডা. ওমর ফারুক সাংবাদিকদের বলেন, ‘সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স ও ধর্ষণ দুটি ভিন্ন বিষয়। মৃত্যুর কতক্ষণ আগে সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স হয়েছে তা বলা যাবে না। তবে যৌনক্রিয়া হয়েছে এবং তার (তনু) যৌনক্রিয়ার অভিজ্ঞতা আছে।’ তিনি জানান, সিআইডি থেকে প্রাপ্ত ডিএনএ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ এবং দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের অন্যান্য পরীক্ষার সমন্বয়ে এ প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। এছাড়া রাসায়নিক পরীক্ষাগার থেকে প্রাপ্ত ভিসেরা প্রতিবেদনে বিষক্রিয়ার কোন আলামত পাওয়া যায়নি বলে তিনি জানান ।

কুমিল্লা সেনানিবাসের একটি জঙ্গল থেকে গত ২০ মার্চ রাতে তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়। পরদিন কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজে তার প্রথম ময়নাতদন্ত করেন ওই কলেজের প্রভাষক ডা. শারমিন সুলতানা। তিনি গত ৪ এপ্রিল ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে তনুর মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করা হয়নি এবং ধর্ষণের আলামতও পাওয়া যায়নি। এদিকে আদালতের নির্দেশে গত ৩০ মার্চ দ্বিতীয় দফায় ময়নাতদন্তের জন্য তনুর লাশ কবর থেকে উত্তোলন ও ডিএনএ আলামত সংগ্রহ করা হয়। গত ১৪ মে কুমিল্লার আদালতে এসে পৌঁছায় নিহত তনুর ৭টি বিষয়ের ডিএনএ প্রতিবেদন। এতে তনুর ভেজাইনাল সোয়াবে পৃথক ৩ জন পুরুষের শুক্রানু পাওয়া যায়। তনুর ডিএনএ পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত পাওয়ায় প্রতিবেদনটি দেওয়ার জন্য সিআইডিতে চিঠি পাঠান মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান ডা. কামদা প্রসাদ সাহা। একাধিকবার চিঠি চালাচালির পর আদালতের নির্দেশে গত ৭ জুন ফরেনসিক বিভাগের চাহিদা মোতাবেক তনুর ভেজাইনাল সোয়াব, দাঁত, চুল, অন্তর্বাস, কাপড়সহ ৭টি বিষয়ের ডিএনএ প্রতিবেদন ফরেনসিক বিভাগে হস্তান্তর করে তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি।

প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে ডা. কামদা প্রসাদ সাহা রাতে ইত্তেফাককে জানান, এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারবো না। এ বিষয়ে আমার কোন দায়-দায়িত্ব নেই। যিনি করেছেন (ডা. শারমিন সুলতানা) তিনিই বলতে পারবেন।

‘খুনিদের বাঁচাতে আমার মেয়ের চরিত্র হনন করা হচ্ছে ’: তনুর দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে এ প্রতিবেদনকে মিথ্যা ও বানোয়াট বলে দাবি করেছেন তনুর মা আনোয়ারা বেগম। গতকাল বিকালে কুমিল্লা সেনানিবাসের অদূরে আলেখারচর এলাকায় তিনি সাংবাদিকদের জানান, ‘তনু সবসময় বোরকা পড়ে চলতো, এখন ডাক্তাররা খুনিদের বাঁচাতে আমার মরা মেয়ের চরিত্র হনন করছে।’ তিনি বলেন, সেনানিবাসের ভেতর একটি বাসায় তনুকে হত্যা করে লাশ জঙ্গলে ফেলে দেয়া হয়। আমরা লাশ উদ্ধার না করলে হয়তো শিয়াল-কুকুরে তার লাশ খেতো, তখন হয়তো বলা হতো শিয়াল-কুকুরই তনুকে মেরেছে। ঘাতকরা প্রভাবশালী হওয়ার কারণেই ডাক্তাররা মৃত্যুর কারণ গোপন রেখেছেন। তিনি আরো বলেন, মেয়ে হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে এখন আমাদেরকে সেনানিবাস থেকেই বের করে দেয়ার চেষ্টা চলছে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আমার মেয়েটা সেনানিবাসের ভেতরই মারা গেছে, তার শরীরে এতো জখম থাকার পরও এখন ডাক্তাররা তার মৃত্যুর কারণ খুঁজে পায় না, আমার তনুকে ফেরত্ দেয়া হোক, আমরা সেনানিবাস ছেড়ে চলে যাব। তিনি আরও বলেন, তনুর যদি যৌনক্রিয়ার অভ্যাস থেকেই থাকে তাহলে তার চুল কেন কাটা হল, নাক দিয়ে রক্ত আসল কেন এবং তাকে কেন হত্যা করা হল। এখন আমরা সুষ্ঠু বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছি।

এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি-কুমিল্লার পরিদর্শক গাজী মোহাম্মদ ইব্রাহিম জানান, ফরেনসিক বিভাগ থেকে পাওয়া দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তদন্ত একটি চলমান প্রক্রিয়া, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে যা-ই আসুক ঘটনার পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও স্বাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা হবে। আমরা হত্যাকান্ডের রহস্য উদ্ঘাটন ও ঘাতক শনাক্তে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

ময়নাতদন্তকারী চিকিত্সকের শাস্তি দাবি: কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যার কারণ দ্বিতীয় দফায় ময়নাতদন্তেও চিহ্নিত না হওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন কুমিল্লার বিশিষ্টজনেরা। গণজাগরণ মঞ্চ-কুমিল্লার সমন্বয়ক খায়রুল আনাম রায়হান বলেন, ‘ময়নাতদন্তকারী চিকিত্সক ডা. কামদা প্রসাদ সাহা এ ধরণের রিপোর্ট দিয়ে বিতর্কিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি তনু হত্যার কারণ বের না করে তার চরিত্র হনন করেছেন এবং গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন, এজন্য তাঁর শাস্তি হওয়া দরকার।’

চৌদ্দগ্রামের একটি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মীর শাহ আলম প্রশ্ন করেন, তাহলে তনু মরল কীভাবে? দেশবাসী চায় কালক্ষেপণ না করে তনুর মৃত্যুর সঠিক কারণ দেশবাসীর কাছে উন্মোচন করা হোক। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করুক প্রশাসন।

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা কুমিল্লা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট নাজমুল আলম চৌধুরী নোমান বলেন, তনুর ২য় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়, কেউ তা মেনে নিতে পারে না। এটা পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্যই এ ধরনের অগ্রহণযোগ্য একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করে প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রথম ও দ্বিতীয় ময়নাতদন্তকারী চিকিত্সক একই সূত্রে গাঁথা। হত্যার কারণ উদ্ঘাটন করতে না পারলে এ ধরনের চিকিত্সক দিয়ে কীভাবে আমাদের ফরেনসিক বিভাগ চলবে, কীভাবে মানুষ ন্যায়বিচার পাবে? তিনি প্রথম ও দ্বিতীয় সুরতহাল এবং দুটি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। একই দাবি জানিয়ে ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন নগরীর বিভিন্ন কলেজের শিক্ষক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *