রাজনৈতিক অস্থিরতায় ও দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধের ফলশ্রুতিতে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের বহু লোক। বিশেষ করে ইরাক, সিরিয়া যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তরা। পাহাড়, নদী, মরুভূমি, সাগর পাড়ি দিয়ে তাদের এখন প্রধান গন্তব্য ইউরোপের কোনো দেশ। ইতিমধ্যে কেউ কেউ স্থান পেলেও অনেকেই এখনো আছেন রাস্তায় অপেক্ষমান। কখন খুলবে সীমান্ত। এমনই একটি স্থান গ্রিস-মেসিডোনিয়া সীমান্ত। সেখানে খোলা আকাশের নিচে তাঁবু গেড়ে কোনো মতে মাথা গুঁজে আছেন বহু শরণার্থী। অপেক্ষা কখন বন্ধ সীমান্ত খুলে দেয়া হবে। কিন্তু এই অপেক্ষমাণ সময়েও তো জীবন থেমে থাকে না। কিছু অপরিহার্য কর্ম সারতেই হচ্ছে। এমনই একটি অপরিহার্য কাজ হচ্ছে চুল-দাঁড়ি কামানো। কিন্তু এ কাজের জন্য সেখানকার কোনো সেলুনে যাওয়া যেমন ব্যয়বহুল তেমনি সীমান্তে এ ধরনের ব্যবস্থাও নেই। তাই শরণার্থীদের মাঝে কেউ কেউ হয়ে উঠছেন মৌসুমী ‘নাপিত’।
কারো হয়তো কিছু অভিজ্ঞতা আছে, আবার কারো নেই। কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদে বা কেউ কেউ কিছু উপার্জনের উদ্দেশ্যে। গ্রিস-মেসিডোনিয়া সীমান্তের আইডোমেনি ক্যাম্পের এমনই একটি চিত্র উঠে এসেছে মিডলেইস্টআই-এর এক প্রতিবেদনে। খোলা আকাশের নিচে একটি অর্ধভঙ্গ চেয়ারে চলছে চুল কাটা। তবে পাওয়া যাচ্ছে আধুনিক স্টাইলও। সিরিয়ার আলেপ্পো থেকে আসা আবু মোহাম্মদ। গ্রিসের মতো ব্যয়বহুল স্থানে জীবন ধারণের ন্যুনতম ব্যয় বহনের জন্য বেছে নিয়েছেন এই পেশা। কথা হয় তার সাথে। জানান, আসাদ সরকার ও রাশিয়ান বিমান হামলায় নিজ মাতৃভূমিতে আর থাকা যাচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নেন ইউরোপের কোনো দেশে পাড়ি জমানোর। বহু পথ পাড়ি দিয়ে হাজির হন এই ক্যাম্পে। জীবন ধারণের কঠোর বাস্তবতায় বেছে নেন এই পেশাটিকেই। কোনোক্রমে জোগাড় করেন একটি চেয়ার, এক জোড়া কাঁচি, একটি প্রায় ঝাপসা হয়ে যাওয়া কাঁচ ও একটি হেয়ার ড্রেসার। হেয়ার ড্রেসারটি চালাতে গ্রিসের একটি রেস্তোরাঁ থেকে বিদ্যুতের লাইনের ব্যবস্থা করেছেন। এই নিয়েই চলছে তার এই ‘নাপিতগিরি’। প্রতিটি চুল কাটায় তিনি নিচ্ছেন দুই থেকে তিন ইউরো। ‘আমার ছেলে-মেয়ে রয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে যা পাই তা দিয়ে জীবন চলছিল না। তাই কিছু একটা করার চিন্তা থেকেই এ কাজে নেমে যাওয়া’, বলছিলেন আবু মোহাম্মদ।
সেখানে পাওয়া যায় এক আফগান তরুণকে। দেখা যায় একটি ছোট্ট আয়না ও একটি রেজর দিয়ে কোনোমতে নিজেই নিজের শেভ করে নিচ্ছে। কারণ হিসেবে জানা যায়, সেলুনে শেভ করার পয়সা তার জোগারে নেই। রেললাইনের পাশে একটি চেয়ার বসিয়ে চুল কাটতে দেখা যায় এক নারীকে। সিরিয়ার কামিশলি থেকে আসা এ কুর্দি নারী এখানে এসেছেন মাসখানেক আগে। সাথে আছে স্বামী ও দুই সন্তান। তুরস্কের ইজমির শহর থেকে নৌকাযোগে এখানে এসে পৌঁছান তারা। বাঁচার তাগিদেই গ্রিসের থেসালোনিকি শহর থেকে একটি চেয়ার ও কিছু চুল কাটার যন্ত্র সংগ্রহ করে শুরু করে দিয়েছেন এ ‘পেশা’। তিনি প্রধানত মেয়েশিশুদের চুল কাটেন। তিনি জানান, ‘পিপলস প্রটেকশন ইউনিক (ওয়াইপিজি) ও আইএসের মধ্যে সংঘর্ষে আমাদের গ্রামটি ধ্বংস হয়ে যায়। তাই পাড়ি দিয়েছিলাম তুরস্কে। কিন্তু যেহেতু তুরস্ক কুর্দিদের পছন্দ করে না তাই আমাদের রওয়ানা দিতে হলো
ইউরোপের উদ্দেশে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা দালালদের ১৬০০ ডলার দিয়েছি ইউরোপে ঢুকতে। কিন্তু আমরা জানতাম না যে ইউরোপ আমাদের জন্য তাদের দরজা বন্ধ করে দেবে। তাই এখানে পৌঁছে ছেলেমেয়েদের কথা বিবেচনা করে যুক্ত হয়ে গেছি এ কাজে।’ কাবানি থেকে আসা সিরিয়ান-কুর্দি জামালও জানালেন তিনি তুরস্কে কঠোর পরিশ্রম করে জার্মানি যাওয়ার জন্য যে অর্থ যোগাড় করেছিলেন কিন্তু সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গত ৪০ দিন ধরে এখানে আটকে থেকে তার সে সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে। আইডোমেনি ক্যাম্পে বিভিন্ন এনজিও থেকে কিছু সাহায্য আসছে ঠিকই কিন্তু প্রয়োজনের তুলনা তা নিতান্তই সামান্য। তাই অনেকে জীবন বাঁচানোর তাগিদে এ স্থান ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন অন্য কোনো উপায়ের খোঁজে। সম্প্রতি একটি এনজিও থেকে বিতরণ করা খাবার দেখা গেছে, এগুলো সবই পঁচা, দুর্গন্ধময়। এগুলো খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রায় ১৫ শরণার্থী। তবে শেষ কথা হলো, যতদিন না সীমান্ত খুলছে ততদিন শরণার্থীদের এখানেই থাকতে হচ্ছে। আর চুল কাটার প্রয়োজন যেহেতু মানুষের একটি নিয়মিত প্রয়োজন তাই এই মৌসুমী ‘নাপিত’দের কাজের অভাব হবে না- এ কথা বলাই যায়।
Read More News