বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য সাবেক গভর্নর সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর বেফাঁস মন্তব্য, দুই মন্ত্রীর আদালত অবমাননার অভিযোগ, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রথম দফার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক প্রাণহানি এবং ব্রিটেনে সরাসরি কার্গো বিমান নিষিদ্ধ হওয়া নিয়ে বিব্রত অবস্থায় পড়েছে সরকার। এসব ইস্যুতে দেশ-বিদেশে নানা ধরনের সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের নীতিনির্ধারকদের। সরকারের বিভিন্ন ফোরামেও এসব বিষয় আলোচনায় উঠে আসছে। শুধু তাই নয়, দল ও সরকারের ভাবমর্যাদা নষ্ট করার অভিযোগে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি জানাচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের সিনিয়র নেতারা। এমন প্রেক্ষাপটে মন্ত্রিসভায় পরিবর্তনেরও আওয়াজ উঠেছে বিভিন্ন ফোরামে।
Read More News
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, রাষ্ট্রীয় কোষাগার (রিজার্ভ) থেকে অর্থ চুরি নিয়ে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সাথে নিজের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে টেনে নিয়ে দল ও সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এমন অভিযোগ খোদ আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের। গত রোববার দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকেও ঘুরেফিরে আলোচনায় এসেছেন অর্থমন্ত্রী। একটি বাংলা দৈনিকে পদত্যাগী গভর্নর আতিউর রহমানের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের দেয়া সাম্প্রতিক বক্তব্যে দলের নেতা এবং দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বৈঠকে দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন। পরে একে একে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও শেখ ফজলুল করিম সেলিম এবং কোষাধ্য এন এইচ আশিকুর রহমানও কথা বলেন। পরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, গভর্নরের পদত্যাগের পরও তাকে নিয়ে মন্ত্রীর এরকম প্রকাশ্য বক্তব্য বোধগম্য নয়। আতিউর রহমানের সাথে অর্থমন্ত্রীর ‘ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের’ বিষয়টি এভাবে পত্রিকায় না নিয়ে এলেই অর্থমন্ত্রী ভালো করতেন বলেও প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন।
অর্থমন্ত্রীর সাথে পদত্যাগী গভর্নর সম্পর্ক নিয়ে ফেসবুকে নানা ধরনের ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য করে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিনের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ ঝাড়েন উপস্থিত কয়েক নেতা। পরে তিনি নিজের বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
ওই বৈঠকে দলের নেতাদের প্রশ্নবাণে পড়েন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম মন্ত্রীদের ‘লাগামছাড়া’ বক্তব্যের বিষয়ে কথা বলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে দুই মন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও আ ক ম মোজাম্মেল হকের বক্তব্যের সমালোচনা করে নাসিম বলেন, ‘মন্ত্রীরা এভাবে কথা বললে সরকারের ভাবমর্যাদা সঙ্কটে পড়ে।’
এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কারাগারে আটক মীর কাসেম আলীর চূড়ান্ত রায়ের আগে ঢাকায় এক আলোচনা সভায় প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে নতুন বেঞ্চ গঠন করে আপিলের পুনঃশুনানির দাবি তোলেন কামরুল। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে একই মঞ্চে ওই দিন কথা বলেন, মুক্তিযোদ্ধামন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকও। তাদের মতে, প্রধান বিচারপতি আপিলের বেঞ্চে থাকলে মীর কাসেম আলী খালাস পেয়ে যেতে পারেন। এই বক্তব্যের পর বিচারিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন মহলে তোলপাড় শুরু হয়। এমন বক্তব্যে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে দুই মন্ত্রীকে তলব করেন আপিল বিভাগ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রভাবশালী এক নেতা মন্ত্রীদের বিষয়ে ােভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এসব মন্ত্রী নিয়ে কোনো কথা নেই। তারা কখন কী বলে, নিজেরাই জানে না। তারা কাজের চেয়ে দল ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই পছন্দ করেন বলে মনে হয়।’
এ দিকে গত ২২ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সন্ত্রাস, কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাইসহ সারা দেশে ব্যাপক হতাহতের ঘটনায় বিব্রত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলীয় প্রতীকে প্রথমবারের মতো এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অন্তত ২৩ জনের প্রাণহানিতে রীতিমতো নির্বাক শাসক দল ও সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। মুখে যাই বলা হোক না কেন, এখন আগামী ধাপের নির্বাচনগুলো নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তারা। সে জন্য এ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে সহিংসতা কমিয়ে এনে সরকারদলীয় প্রার্থীদের কিভাবে বিজয় নিশ্চিত করা যায় তা নিয়ে ভাবছেন শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, সর্বশেষ অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও অপেক্ষাকৃত কম সহিংসতাকে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের বড় ধরনের সাফল্য হিসেবে দেখছিল আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে ব্যাপক কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাইসহ নানা কৌশলে ক্ষমতাসীনদের বিজয়ের সমালোচনা করলেও কম সহিংসতাকে বেশ ইতিবাচক হিসেবে দেখেছেন পর্যবেক্ষকরাও। সে জন্য একই ধারাবাহিকতায় এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও সন্ত্রাস, সহিংসতা এড়িয়ে দলীয় প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিতের ব্যাপারে বেশ আশাবাদী ছিলেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদে প্রথম ধাপের নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের নিরঙ্কুশ বিজয় ছিনিয়ে আনা হলেও বড় ধরনের সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনা তাদের অবাক করে দিয়েছে। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নিজেও দলীয় নেতাদের সাথে আলাপকালে বিষয়টি নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ নির্বাচনে ব্যাপক প্রাণহানিতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। একই সাথে আগামী ধাপের নির্বাচনগুলোতে এ ধরনের সহিংসতা ও প্রাণহানি ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী।
এ ছাড়া সম্প্রতি ব্রিটেনে সরাসরি কার্গো বিমান নিষিদ্ধ হওয়ার খবরে চাপের মুখে পড়েছে সরকার। শুধু তাই নয়, ব্রিটেনে যাত্রীবাহী বিমান চলাচলও অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে এমন আভাসে আরো চিন্তিত সরকারের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা।
এসব বিষয়ে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা আলাপকালে বলেন, এবার মন্ত্রীদের আচরণে যখন দল ও সরকারের ভাবমর্যাদা প্রশ্নের সম্মুখীন তখন নেতারা মুখ খোলা শুরু করেছেন; যা দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদেও তুমুল আলোচনা হয়। আসলে এটি ছিল মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে নেতাদের দীর্ঘ দিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। কারণ, দলটির নেতারা বলছেন, ব্যক্তিগত সহকারী দিয়ে মন্ত্রীরা মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন। সরকারের উন্নয়ন আর রাজনীতি একসাথে চলছে না। এ কাজটি অনেক মন্ত্রী সহজে করতেও পারছেন না। এ কারণেই এ বয়সে এসেও সারা দেশে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতিকে ছুটে বেড়াতে হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সামনে এর আগেও অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে ােভ প্রকাশ করা হয়েছে। মন্ত্রীদের অতিকথন নিয়েও বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড সতর্ক করেছে। দলের এমপিদের আচরণ নিয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু এবার একসাথে তিন মন্ত্রীর আচরণ, গণমাধ্যমে দেয়া বক্তব্য, এক নেতার ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে এক সাথে সবাই দলীয় নেতাদের প্রশ্নের মুখে পড়ছেন।