বডিলাইন সিরিজ, ক্রিকেটের সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায়। ক্রিকেটে কাপুরুষতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন হয়ে আছে ইংলিশ অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিনের মস্তিষ্ক প্রসূত কৌশলটি। তবে ১৯৩২-৩৩ মৌসুমের ওই অ্যাশেজে ইংল্যান্ড দলের এক ব্যাটসম্যান ক্রিকেটকে উপহার দিয়েছিলেন অনবদ্য এক ইনিংস। যে ইনিংসের গল্প এখনো শিহরণ জাগায় মানুষের মনে, যে সাহসিকতার গল্প এত দিন পরেও অবিশ্বাস্য শোনায়।
অ্যাডিলেড টেস্টে খেলতে নামার আগে ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে ছিল ইংল্যান্ড। ১০ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া সেই ম্যাচেও প্রথম দুই দিন এগিয়ে ছিল সফরকারীরা। প্রথম ইনিংসে ৩৪০ করে অলআউট হয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। দ্বিতীয় দিন শেষে বিনা উইকেটে ৯৯ করে ইংল্যান্ড। প্রথম দুই দিনে উল্লেখ করার মতো ঘটনা ছিল শুধু একটি, টনসিলে আক্রান্ত হয়ে এডওয়ার্ড পেইন্টারের মাঠ ছেড়ে চলে যাওয়া। জ্বরে কাবু পেইন্টারের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, ওই টেস্টে তাঁর আর ব্যাট করা হবে না বলে লিখেই দিয়েছিল পত্রপত্রিকা।
কিন্তু তৃতীয় দিনে ম্যাচে ফিরে আসে অস্ট্রেলিয়া। একের পর এক উইকেট তুলে নিয়ে বিপাকে ফেলে দেয় ইংল্যান্ডকে। হাসপাতালে সঙ্গ দিতে যাওয়া বিল ভোসের কাছে দলের বিপর্যয়ের কথা শুনেই বিছানা ছেড়ে চলে আসেন পেইন্টার। ট্যাক্সি ভাড়া করে রোগীর পায়জামা পরে যখন মাঠে এলেন, ইংল্যান্ডের স্কোর ৫ উইকেটে ১৯৮। কিছুক্ষণের মাঝেই সেটি পরিণত হলো ৬ উইকেটে ২১৬। মাঠে নামলেন পেইন্টার। সে মুহূর্তের কথা পরে জানিয়েছেন বডি লাইন সিরিজের নায়ক (কিংবা খলনায়ক, যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চান) হ্যারল্ড লারউড, ‘আমি কখনো ওই চেহারা ভুলব না। সে ভয়াবহ অসুস্থ ছিল, পুরো মুখ ফ্যাকাশে। এমনিতেও সে কম কথার মানুষ, সেদিন সে একেবারেই কথা বলছিল না। তবে উডফুল (অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক) সেদিন খুব সহযোগিতা করেছিল।’
পেইন্টারের সাহসী সিদ্ধান্ত সেদিন অস্ট্রেলিয়ার সমর্থক ও খেলোয়াড়দের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। বিল উডফুল তো রানার নেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন তাঁকে। কিন্তু দৃঢ় প্রত্যয়ী এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান সেই প্রস্তাবে সায় দেননি। বরং বল বাউন্ডারির কাছাকাছি পাঠিয়ে রান বের করার কৌশল ব্যবহার করেছেন তিনি।
Read More News
পেইন্টার উইকেটে আসার কিছুক্ষণ পরেই শেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান লেস অ্যামেস আউট হয়ে যান। এরপর লারউড দ্রুত কিছু রান তুলে দিয়েই বিদায় নেন, একপ্রান্তে ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন পেইন্টার। তৃতীয় দিন শেষে ইংল্যান্ডের স্কোর দাঁড়ায় ৮ উইকেটে ২৭১, পেইন্টার অপরাজিত ছিলেন ২৪ রানে। দিনের খেলা শেষ হতেই আর পারলেন না পেইন্টার, আবারও হাসপাতালে গেলেন শুশ্রূষার জন্য।
ম্যাচের চতুর্থ দিন, ১৪ ফেব্রুয়ারি পেইন্টারের সৌজন্যে ক্রিকেট দেখল সব সাহসী এক ইনিংস। সকালেই হাসপাতাল থেকে মাঠে চলে এলেন তিনি। প্রায় চার ঘণ্টার এক ইনিংসে ধৈর্য, একাগ্রতা আর মানসিক শক্তির মিশেলে করলেন ৮৩ রান। ২১৮ বলে ১০টি চারে খেলা সেই ইনিংসে সঙ্গী পেয়েছিলেন পুরোনো বন্ধু হেডলি ভেরাইটিকে। তাঁকে নিয়ে নবম উইকেটে ৯২ রানের এক জুটি গড়ে দলকেও এনে দেন ১৬ রানের গুরুত্বপূর্ণ লিড। তাঁর এনে দেওয়া সেই লিড ও সাহসী ইনিংসের জবাব আর দিতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া।
দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া করতে পেরেছিল মাত্র ১৭৫ রান। ইংলিশরা ম্যাচটাও জিতে নিয়েছিল ৬ উইকেটে। ম্যাচের শেষটাও হয়েছিল সর্বাঙ্গম সুন্দর—ছক্কায়। আর সেই ছক্কাটি আসে ‘সাহসী’ পেইন্টারের ব্যাটে!