পাশ্চাত্যের সাথে পরমাণুবিষয়ক চুক্তির প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন সমীকরণের সৃষ্টি হয়েছে ইরানের। ইরানি নেতৃত্বেও পরিবর্তন আসছে। আবার দেশটির প্রতিবেশী পাকিস্তানও নানা কারণে লাইমলাইটে আছে। দেশ দু’টির মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে। সম্প্রতি খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক আলেক্স ভ্যাতানকা ইরানের পররাষ্ট্রনীতি, ইরান-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে দি ডিপ্লোমেটের মোহাম্মদ আকবর নোটেজাইকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
Read More News
প্রশ্ন : ইরানের পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী?
আলেক্স : ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের পর থেকে ইরানি পররাষ্ট্রনীতিতে বর্তমানেই সবচেয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। বর্তমানে ওই বিপ্লবের অনেক বিজয়ী নারী-পুরুষ তাদের সৃষ্ট সেই ক্ষতির কিছুটা মেটানোর চেষ্টা করছেন। এটা ক্রেতার বিবেক দংশনের (নুঁবৎ’ং ৎবসড়ৎংব) মতো। বিপ্লবের সময় দেয়া বিপুল প্রতিশ্র“তি কখনো পূরণ করা হয়নি। এটা বোকামিতে ঠকে যাওয়ার মতো অবস্থা। পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবতার ব্যাপারেও সত্য। ইসলামি বিপ্লবের প্রথম দশকটি ছিল পাশ্চাত্যপন্থী মোহাম্মদ রেজা পাহলভির (শাহ) কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণকারী ইসলামি বিপ্লবীদের কারো পরোয়া না করে একলা চলার ব্যাপার। তবে ওই দশকের শুরুতে ইরানের পররাষ্ট্রনীতি ছিল পুরোপুরি আশাহীন অবস্থায়। ইসলামপন্থীদের সব গর্ব ও স্লোগান সত্ত্বেও ১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধ শেষে তেহরান সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ অনানুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, তারা একাকী থাকবে এবং স্বাধীনতার অর্থ কোনোভাবেই বিদেশীভীতি এবং বহির্বিশ্বকে প্রত্যাখ্যান নয়। তারা ঠেকে ঠেকে এই শিক্ষাটি গ্রহণ করেছে। আয়তন ও জনসংখ্যায় তিন গুণ ছোট ইরাক সামরিকভাবে ইরানকে প্রায় হারিয়েই দিয়েছিল। কারণটি খুবই সহজ : ইরাক তার পেছনে বিশ্বকে পেয়েছিল; ইরান নিজেকে নিঃসঙ্গ করে ফেলেছিল। যারা বিশ্বাস করেন, আবারো ১৯৮০-এর দশকের মতো বসবাস করা হবে ইরানের জন্য অর্থনৈতিকভাবে এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে বিপর্যয়কর, তাদের মধ্যে তেহরানে প্রেসিডেন্ট পদে আছেন যে লোকটি, সেই হাসান রুহানিও আছেন, যদিও তার অনেক কট্টর প্রতিদ্বন্দ্বী সেভাবেই থাকতে চান। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রুহানি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, সুস্পষ্টভাবে বিচ্ছিন্ন থাকার মানে হলো ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যৎকে বিপদগ্রস্ত করা। তবে আইডিয়ার যুদ্ধ এখনো চলছে।
প্রশ্ন : সরকারিভাবে ইরান পরমাণু চুক্তিটি বাস্তবায়ন করছে এবং পরমাণু সম্পর্কিত বিধিনিষেধ উঠে গেছে। এতে করে ইরান এবং এর প্রতিবেশী, বিশেষ করে পাকিস্তানের জন্য কী অর্থ প্রকাশ করছে?
আলেক্স : এর অর্থ হচ্ছে ইরানের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপকভাবে অনুমোদনযোগ্য। ব্যতিক্রমও আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে ইরানের ওপর মার্কিন অবরোধ বহাল থাকায় ইরান-সম্পর্কিত আর্থিক লেনদেনে আমেরিকান ব্যাংকগুলো অংশ নিতে পারছে না। অবশ্য, ইরান ও এর প্রতিবেশীরা একে অন্যকে বিশ্বাস করলে ২০০৬ সাল থেকে ইরানের ওপর আরোপ করা বাস্তব বাধাগুলো অপসারণ করা নিয়ে চিন্তাভাবনা করবে। ইরানের কিছু প্রতিবেশী তেহরানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। এগুলো হচ্ছে- ইরাক, আর্মেনিয়া, ওমান, আফগানিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান। অন্যরা ঐকান্তিক নয়। এগুলোর মধ্যে পারস্য উপসাগরে ইরানের বেশির ভাগ আরব প্রতিবেশী এবং তুরস্ক ও পাকিস্তানও থাকবে। তবে ইরান এমন বিশাল এক প্রতিবেশী, যাকে অগ্রাহ্য করা কঠিন ব্যাপার। এমনকি আপনি যদি ইরানে না-ও যান, তবে ইরানই আপনার কাছে এসে পড়বে। ঠিক এ কারণেই পৃষ্ঠা উল্টানো এখন খুবই দরকারি। পাকিস্তানের মতো দেশের ইরানের সাথে মারাত্মক মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। সময়ের পরিক্রমায় চড়াই-উতড়াই থাকলেও ইরান-পাকিস্তান সম্পর্কে গভীর কোনো বৈরিতা নেই। যা আছে তা হলো একে অপরের প্রতি আগ্রহের অভাব। তবে আমি আমার বই ইরান-পাকিস্তান : সিকিউরিটি, ডিপ্লোম্যাসি অ্যান্ড আমেরিকান ইনফ্লুয়েন্স-এ উল্লেখ করেছি, এ দুই প্রতিবেশী ৩০ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে পশ্চিম এশিয়ার দুই বৃহৎ শক্তি। একসাথে তাদের অনেক কিছুই করার আছে এবং তারা তা করলে তা হবে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা থেকে আঞ্চলিক জ্বালানি সহযোগিতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পুরো অঞ্চলের জন্য কল্যাণকর।
প্রশ্ন : পরমাণু চুক্তির পর ইরান-পাকিস্তান গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প কি এগোতে পারে?
আলেক্স : এই শান্তি পাইপলাইন নিয়ে প্রায় ২০ বছর ধরে আলোচনা চলছে। এটা বিরাট সম্ভাবনাময় এবং বাস্তবসম্মত। ইরানের রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম গ্যাস মজুদ, তাদের প্রয়োজন বাজার। জ্বালানির অভাব রয়েছে পাকিস্তান, তবে মাঝখানে আছে রাজনীতি। অবশ্য আশাবাদ অনুযায়ী ইরান তার নীতি শিথিল করলে ভূরাজনৈতিক বাধাগুলো শিগগিরই দূর হতে পারে। এতে করে পাইপলাইনের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। এটা সবার জন্যই হবে লাভজনক।
গ্যাস পাইপলাইন বেশ ভালো প্রকল্প। তবে গ্যাসের দাম এবং পাকিস্তান অংশের পাইপলাইন নির্মাণের ব্যয় কে দেবে তা নিয়ে সমস্যা রয়ে গেছে। তবে পাইপলাইনটি যদি ভারতেও যায়, (তা যেতেই পারে) তবে তা বাণিজ্যিকভাবে আরো লাভজনক হবে।
প্রশ্ন : শিয়া ইরান ও সুন্নি পাকিস্তানের মধ্যে কোন ধরনের উত্তেজনা আপনি দেখছেন?
আলেক্স : কোনো দেশের এই আগুন নিয়ে খেলা উচিত নয়। ইরান হলো বিশ্বের বৃহত্তম শিয়া দেশ; পাকিস্তানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিয়া জনগোষ্ঠী রয়েছে, প্রায় চার কোটি। সম্প্রদায়বাদ বেশি হওয়া পাকিস্তানের জন্য বিপর্যয়কর হবে। এটা এমন এক আগুন, যা ইরানসহ পুরো অঞ্চলকেই পুড়িয়ে শেষ করে দেবে। মনে রাখতে হবে, ইরানে আছে ৮০ লাখ শক্তিশালী সুন্নি মুসলমান। সঙ্কীর্ণ লাভের জন্য ধর্মীয় পার্থক্যকে কোনো পক্ষই উসকে দেবে না, এমন আশাবাদ থাকাই ভালো।
পাকিস্তানের জন্য শিয়া-সুন্নি সঙ্ঘাত হবে বিপর্যয়কর। এ কারণে এটা দূর করতে তারা সব কিছুই করবে। আমি মনে করি, স্বল্পমেয়াদে পাকিস্তানের জন্য সম্প্রদায়গত হুমকি ভারতের পরমাণু অস্ত্রের হুমকির চেয়েও বড় সমস্যা।
প্রশ্ন : ইরান ও পাকিস্তান কোন ধরনের সহযোগিতা করতে পারে?
আলেক্স : খুবই কম। তারা কেবল বাণিজ্য করে। আর্মেনিয়ার সাথে ইরান ব্যবসায় করে অনেক বেশি। ৩০ লাখ লোকের ওই দেশটির সাথে ১৯ কোটি লোকের পাকিস্তানের চেয়ে বেশি ব্যবসায় করে। এটা হলো অবিশ্বাসের ব্যাপার। ভারতের সাথে ইরান ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলুক, তা পাকিস্তান চায় না। আর পাকিস্তান মনে করে, ভারতের খুব কাছে ইরান এবং তেহরান বিশেষ করে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় পাকিস্তানের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করার ধান্ধায় রয়েছে। আর ইরান দেখে তার আরব প্রতিদ্বন্দ্বী, বিশেষ করে সৌদি আরবের সাথে জোট বেঁধেছে পাকিস্তান।
এই অবিশ্বাস প্রথমে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। তবে কাজটা সহজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন সময় ও ধৈর্য। তবে সুসংবাদ হলো, কোনো পক্ষই প্রকাশ্য সঙ্ঘাত চায় না। এর বদলে রুহানি ও পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের মধ্যকার সর্বশেষ বৈঠকে অর্থপূর্ণ সংলাপ শুরুর কথা বলা হয়েছে।
আলেক্স ভ্যাতানকা : সিনিয়র ফেলো, মিডলইস্ট ইনস্টিটিউট, জেমসটাউন ফাউন্ডেশন, ওয়াশিংটন ডিসি। তার সাম্প্রতিকতম গ্রন্থ হলো ইরান-পাকিস্তান : সিকিউরিটি, ডিপ্লোম্যাসি অ্যান্ড আমেরিকান ইনফ্লুয়েন্স। তিনি এখন দি মেকিং অব ইরানিয়ান ফরেন পলিসি : কনটেস্টেড ইডিওলজি, পারসোনাল রাইভালারিস অ্যান্ড ডমেস্টিক স্ট্রাগল টু ডিফাইন ইরান’স প্লেস ইন দি ওয়ার্ল্ড নিয়ে কাজ করছেন।